For Advertisement
আমার বিয়ে হলো বাবা মারা যাবার এক বছর পরে।
২ মে ২০২৪, ৭:৩৮:৪৬
আমার বিয়ে হলো বাবা মারা যাবার এক বছর পরে।
আমার বিয়ে হলো বাবা মারা যাবার এক বছর পরে।
বিয়ের পাঁচ মাস পরেই আমার জন্মদিন এলো। আমার স্বামী নিলয় জন্মদিনে আমাকে গিফট দিলো একটা সোনার রিং আর একটা নীল রঙের শাড়ি। সাথে একটা কেক ও আনলো সবাই মিলে খাওয়ার জন্য।
সন্ধ্যায় উপহারের বক্স খুলতেই দেখলাম আমার শাশুড়ী আর ননদের চেহারায় যেনো আষাঢ়ের মেঘ জমেছে। নিলয় আমাকে রিং পরিয়ে দিলো। সবাই মিলে কেক খেয়ে যে যার রুমে চলে আসলাম। রাতে খাবার জন্য আমি সেদিন ফ্রাইড রাইস,চিলি চিকেন,চিকেন ফ্রাই,ভেজিটেবল বানালাম। খেতে বসে শাশুড়ী আম্মা আমাকে বললেন,”রাইফা,নিলয়ের আনা শাড়িটি নীলাকে দিয়ে দিও,নিলয় তোমাকে আরেকটা কিনে দিবে পরে।নীলার খুব পছন্দ হয়েছে শাড়িটি। “
মায়ের বাধ্য ছেলে হওয়ায় নিলয় ও আমাকে বললো দিয়ে দিতে শাড়িটি,হাতে টাকা হলে নিলয় আমাকে আরেকটা কিনে দিবে। আমার চোখে ভেসে উঠলো অনেক বছর আগের সেই দৃশ্য। আমি জোর গলায় বললাম,”না মা,এই শাড়ি আমি দিতে পারবো না।এটা আমার গিফট, আমার স্বামী দিয়েছে।আপাকে ওনার ভাই না-হয় কিনে দিবে হাতে টাকা এলে।”
বিস্ফোরিত চোখে সবাই আমার দিকে তাকালো। আমি শান্ত থেকে বললাম,”আমার বাবার দীর্ঘ দিনের শখ ছিলো মায়ের জন্য কচু পাতা কালার অরিজিনাল একটা জামদানী শাড়ির। বাবা একবার চাকরি সূত্রে টাঙ্গাইল গিয়েছিলেন। তাঁতিদের হাতে বুনা একটা কচু পাতা কালারের একটা জামদানী শাড়ি ও বাবা কিনেছিলেন মায়ের জন্য। মায়ের গায়ের রঙ একেবারে ফর্সা।দুধে আলতা রঙ যাকে বলে। ছোট বেলায় স্নো হোয়াইটের গল্প শোনার পর আমি ভাবতাম আমার মা’কে দেখলে স্নো হোয়াইট ও লজ্জা পাবে।
বাবা ও তাই শখ করেই মায়ের জন্য সেই শাড়িটি কিনেছিলেন। কিন্তু মা’য়ের ভাগ্য খারাপ অথবা বলা যায় বাবার সাহসের অভাব। বাবা তিন ফুফুর জন্য ও তিনটি জামদানী শাড়ি এনেছিলেন। দাদী এসব শাড়ি পরে না বলে দাদীর জন্য একটা সুতি শাড়ি কিনেছিলেন। কিন্তু দাদীর পছন্দ হলো মায়ের জন্য নেওয়া শাড়িটি। সরাসরি বলে বসলেন,”আমার জন্য এইডা কেমন শাড়ি আনছস তুই আমির? না না,এসব শাড়ি তো মজনুর বউ পিন্দে,মজনু রিকশা চালাইয়া এরকম শাড়ি কিনে অর বউর লাইগ্যা।আমার পোলা তো রিকশা চালায় না।আমি তোর বউয়ের জন্য আনা শাড়িডা নিমু,ওইডা আমার ভাল্লাগছে।”
বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকালেন একবার,মা হাসিমুখে শাড়ির প্যাকেটটি দাদীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,”আপনি নিন আম্মা,আমাকে আপনার শাড়িটি দিন।আমার এসব শাড়ি পরতে ভালো লাগে না,অভ্যাস নেই,সুতি শাড়িতেই আরাম লাগে আম্মা।কাজ করতে সুবিধা হয়।”
বড় ফুফু টিপ্পনী কেটে বললেন,”বাপের বাড়িতে এসব দামী শাড়ি পরলেই তো অভ্যাস থাকবে!”
বাবা বলতে পারলেন না কিছু কাউকে।তখন আমার বয়স কতো আর? ১৫ বছরের আমি স্পষ্ট দেখলাম মায়ের বিবর্ণ হাসিমুখ,অশ্রু টলটলে চোখ আর বাবার পরাজিত মুখ। পরের ঈদেই দাদী শাড়িটি বড় চাচীকে দিয়ে দিলেন,ওনার এসব পরতে ভালো লাগে না বলে। বাবা এক্সিডেন্টে পা হারালেন সেই বছর।মায়ের জন্য আর জামদানী শাড়ি কেনা হলো না।
চাচী প্রায়সময় শাড়িটি পরে,সেই শাড়ি দেখলে মায়ের কেমন লাগতো জানি না কিন্তু আমার বুকের ভেতর একটা ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো।
আমি তখন থেকে আমার দাদী,চাচীকে অপছন্দ করা শুরু করি।
বাবার ঔষধ,ছোট ভাইয়ের স্কুলের বেতন,বড় আপার বাবুর দুধ কেনা,ঘরের জন্য নামমাত্র বাজার করা-সবই তো মাস শেষে আমার টিউশনির ৩০০০ টাকা আর বড় আপার একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়িয়ে পাওয়া ৪০০০ টাকা বেতনে হতো। এই টাকার মধ্য থেকে আমার উপায় ছিলো না মা’য়ের জন্য এরকম দামী একটা শাড়ি কেনার।
মাঝেমাঝে বাবার ঔষধ শেষ হলে বাবা সবার আড়ালে আমার দুহাত চেপে ধরে বলতেন,”আমার আর ঔষধ লাগবে না রে মা,তুই কয়েক মাসের ঔষধের টাকা জমিয়ে তোর মা’কে একটা জামদানী শাড়ি কিনে দিবি মা?আমার খুব শখ ছিলো তোর মা’কে এই শাড়িতে দেখার।”
আমি বাবাকে মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতাম।বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন,”আমি কোনোদিন তোর মা’কে কিছু দিতে পারলাম না রে মা।আমি একজন অযোগ্য স্বামী,অযোগ্য পিতা।আমার জন্য আর টাকা নষ্ট করিস না।”
বাবার কথাকে আমি পাত্তা দিতাম না।তবে বাবা ঘুমিয়ে গেলে মাঝেমাঝে বাবার পায়ের পাশে বসে বলতাম,”তুমি আমার জন্মদাতা বাবা,তোমার জন্যই তো এই পৃথিবীতে আসতে পেরেছি আমি বাবা।বুক ভরে এই পৃথিবীর তাজা বাতাস শ্বাস নিতে পারছি।তুমি অযোগ্য নও বাবা,অযোগ্য আমি বাবা।তোমার একটা ইচ্ছে আমি পূর্ণ করতে পারছি না।”
বাবা মারা গেলেন সে-বছরই,সাথে করে নিয়ে গেলেন একবুক আফসোস। স্ট্রোক করে মারা গেলেন বাবা।মারা যাবার আগ মুহূর্তে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বাবা বললেন,”মা রে,একটা শাড়ি…..
বাবার সেই অব্যক্ত কথা আমি জানি।বাবা মারা যাবার পর মা নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছিলেন বিবর্ণ বস্ত্রে।
ইন্টার পাস করার পর আমার একটা ছোট চাকরি হলো।প্রথম কয়েক মাসের বেতনের টাকা জমিয়ে আমি মায়ের জন্য একটা কচু পাতা রঙের জামদানী শাড়ি কিনেছিলাম।
সেই শাড়ি বুকে জড়িয়ে ধরে মা বললেন,”এখন আর কি হবে রে মা এই শাড়ি দিয়ে? আমাকে এই শাড়ি পরনে দেখতে চাওয়া মানুষটা তো নেই।এখন আমি অপেক্ষায় আছি কাপনের কাপড় পরার।”
আমার কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে আটকে ছিলো। মা আর সেই শাড়ি কখনো পরে নি,আমরা আর জোর করি নি। মাঝেমাঝে মাঝরাতে দেখতাম মা সেই শাড়িটি জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো শুধু। বাবা মারা যাওয়ার ৮ মাস পর দাদী মারা যান।মা’কে দেখেছি দাদীর সব দায়িত্ব পালন করতে সুষ্ঠুভাবে।কিন্তু দিনশেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন,”তোর দাদীর জন্যই তোর বাবা একটা আফসোস নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে গেছেন।আমি কখনোই তোর দাদীর নিষ্ঠুরতার কথা ভুলবো না।
আম্মা,ভেবে দেখেন এরকম গল্প আপনার জীবনে ও আছে।আপা,আপনি ভেবে দেখেন একবার। আপনার সাথে এরকম কিছু না কিছু হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করতে হয় নিলয়।প্রতিবাদ করতে না পারলে আমার মায়ের মতো তীব্র যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।ভাগ্য কখন কাকে কি করে কে জানে। আমি চাই না পুনরায় এরকম কিছু আমার সাথে ঘটুক।”
নীলা আপা চোখের পানি মুছে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,”তোদের দুলাভাইও আমাকে এক জোড়া কানের দুল দিয়েছিলো বিদেশ থেকে আসার পর।আমাকে পরিয়ে দিয়ে বললেন,এই দুল জোড়া দেখেই আমার তোমার কথা মনে পড়েছে নীলা।তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।সবসময় এই দুলটা পরে থেকো,আমি মন ভরে দেখবো তোমায়।
কিন্তু আমার শাশুড়ীর সেটা পছন্দ হয়ে গেলো। তোর দুলাভাই ও মায়ের পছন্দ শুনে দিয়ে দিলেন,আমাকে বললেন পরের বার আসার সময় উনি আমার জন্য আরেক জোড়া দুল আনবেন। এমন না যে আমার শাশুড়ীর জন্য উনি কিছু আনেন নি,ওনার জন্য একটা গলার চেইন এনেছিলেন।তবুও আমার শাশুড়ী আমাকে দুল জোড়া দেন নি।
পরের বার তো উনি লাশ হয়ে ফিরলেন রে রাইফা।আজও আমার মনে পড়ে আমার স্বামীর পছন্দ করে আনা সেই দুলের কথা।সেই দুল আমার শাশুড়ী তার বড় মেয়ের ঘরের বড় নাতনিকে দিয়ে দিয়েছেন।
আজও আমি মনে পড়লে আল্লাহকে বলি,আল্লাহ তুমি বিচার কইরো। আমার স্বামী শখ করে যে জিনিস আমার জন্য এনেছে,সেই জিনিস কেড়ে নিয়ে যে আমার স্বামীর শখ পূরণ করতে দেয় নাই,তার বিচার কইরো। আমার বিরাট বড় ভুল হয়েছে,আমাকে মাফ করে দিস।”
সেদিন যদি আমার বাবা অথবা মা কেউ একজন জোর গলায় প্রতিবাদ করতো তাহলে আর বাকী জীবন দুজনকে এই আফসোস করতে হতো না।
নীলা আপার স্বামী যদি সেদিন তার মা’কে বলতে পারতেন এটা আপার জন্যই এনেছেন তবে আজ স্বামীর মৃত্যুর পরেও নীলা আপার সেই আফসোস থেকে যেতো না।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে নেই।প্রিয় মানুষের দেওয়া কিছু ছোট ছোট জিনিস ও একান্ত ব্যক্তিগত হয়।যার ভাগ কাউকে দেওয়া যায় না।সে যতোই আপনার লোক হোক।
সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা এমনি এমনি আসে না।এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো জমতে জমতে মনে এক সময় তিক্ততার মহাসাগর বানিয়ে ফেলে।
সহজ সম্পর্ক তখন জটিল হয়ে যায় তখন।
সমাপ্ত
For Advertisement
Cumillar Voice’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
© Cumillar Voice ২০২৪ - Developed by RL IT BD
মন্তব্য