For Advertisement
নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিবাহিত জীবন কেমন ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিবাহিত জীবন ও পরবর্তী বংশধরদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।
২ জুন ২০২৪, ৫:০৭:০৯
নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিবাহিত জীবন কেমন ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিবাহিত জীবন ও পরবর্তী বংশধরদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিবাহিত জীবন কেমন ছিল? নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিবাহিত জীবন ও পরবর্তী বংশধরদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।
সিরাজউদ্দৌলার ক’টা বিয়ে ? কি ভাবে বিয়ে? কার কার সাথে বিয়ে ? প্রথম স্ত্রীর নাম কি? লুতফুন্নিসা কি সিরাজের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন? আলেয়া কে? সিরাজউদ্দৌলার বিয়ের অনুষ্ঠান কেমন হয়েছিল? কিভাবেই বা হয়েছিল ? পলাশীর যুদ্ধের পর সিরাজউদ্দৌলার বংশধরদের কি হয়েছিল? ইত্যাদি ইত্যাদি…আজ সেইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন নবাব আলিবর্দীর খানের ছোট মেয়ে আমিনা বেগম ও হাজী আহমদের ছোট ছেলে জৈন-উদ-দীন আহমেদের প্রথম সন্তান। জন্মের পরই আলিবর্দী খান তাকে দত্তকপুত্র রূপে গ্রহণ করেছিলেন। আমিনা বেগমের মেজ ছেলে ইকরাম-উদ্দৌল্লাকে দত্তকপুত্র রূপে গ্রহণ করেছিলেন সিরাজের মাসি ঘষেটী বেগম ও তাঁর স্বামী নওয়াজেশ মহম্মদ খান কারন তারা ছিলেন নিঃসন্তান।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনের প্রথম বিয়ে ঠিক হয়েছিল রাজমহলের ফৌজদার আতাউল্লা খাঁর মেয়ের সাথে। আতাউল্লা খাঁ ছিলেন বাংলার দ্বিতীয় নবাব সুজাউদ্দিনের আত্মীয় তাছাড়াও তিনি ছিলেন নবাব আলিবর্দী খানের দাদা হাজী আহমদের কন্যা রাবেয়া বেগমের স্বামী। আলিবর্দী খান বাংলার সুবাদারি লাভ করার পর তিনি আতাউল্লাহ খানকে রাজমহলের ফৌজদার পদে নিয়োগ করেন এবং বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি সেই পদেই বহাল থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর সেই মেয়ে মারা গেলে বাগদান পর্ব হয়ে থাকলেও সিরাজউদ্দৌলার সেই বিয়ে আর হয়না।
সিরাজ-উদ-দৌলার বাগদত্তা আতাউল্লাহ খানের সেই মেয়ের মৃত্যুর পর মির্যা ইরাজ খানের এক মেয়ে ওমদাতুন্নেসার সঙ্গে সিরাজের বিয়ে ঠিক হয়। তবে আতাউল্লাহ খানের আর একটি মেয়ের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার ভাই ইকরাম-উদ-দৌলার বিয়ে হয় অত্যন্ত সমারোহের সঙ্গে। যদিও ভাই ইকরাম-উদ-দৌলার বিয়ের অনুষ্ঠানই প্রথমে হয় এবং তারপর হয় সিরাজউদ্দৌলার বিয়ে। এবং সেই বিয়ের অনুষ্ঠানও চলে প্রায় একমাস ধরে।
আসুন এবার সিরাজউদ্দৌলার শশুড় , অর্থাৎ ওমদাতুন্নেসার পিতা মির্যা ইরাজ খানের একটু পরিচয় জেনে নেওয়া যাক। ইরাজ খানের পিতামহ মোস্তফা কুলি খান ছিলেন সম্রাট আওরঙযেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আযমের দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রী। গুজরাট রাজ্যের সুবাদার হিসাবে আযমশাহ আহমেদাবাদে থাকাকালীন সেই নগরে মোস্তাফা কুলি খান ছিলেন শাহজাদার পরেই বিশিষ্ট্য ব্যক্তি। তার তিন পুত্রের মধ্যে একজন হলেন ইরাজ খানের পিতা আকবর কুলি খান। এই আকবর কুলি খান ছিলেন অত্যন্ত চরিত্রবান ও বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তি ।
পরবর্তীকালে আকবর কুলি খান ভাগলপুরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। সেখান থেকে তিনি বাংলায় চলে আসেন এবং সম্মান ও কৃতিত্বের সঙ্গে দিন অতিবাহিত করেন। ততকালীন বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন ইরাজ খানের গোটা পরিবারকেই চিনতেন এবং তাদের সবার প্রতিই তার অসীম শ্রদ্ধা ছিল। গিরিয়াতে নবাব সরফরাজ খানের সাথে আলিবর্দী খানের যে যুদ্ধ হয় তাতে তিনি সরফরাজ খানের পক্ষেই ছিলেন। সেই যুদ্ধে ইরাজখানের পুত্রও নিহত হয়েছিলেন এবং তিনি নিজেও সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েছিলেন। এর পর তিনি তার মুর্শিদাবাদের বাড়িতে অবসর জীবন যাপন করতে শুরু করেন। কিন্তু নবাব আলিবর্দী খান তার সব গুণের কথা জানতেন এবং তিনি তাকে দরবারে ডেকে পাঠান ও চাকরি দেন। নবাবের দরবারে তিনি যথেষ্ট সম্মান পেতেন নবাব আলিবর্দী খান ইরাজ খানের পূর্বপুরুষদের সুখ্যাতি ও এই পরিবারের গৌরবের কথা খুব ভাল করেই জানতেন তাই তিনি ইরাজ খানের মেয়ে ওমদাতুন্নিসার সাথে সিরাজ-উদ-দৌলার বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং ইরাজ খান তাতে রাজিও হয়ে যান।
নবাব আলিবর্দী তাঁর আযিমাবাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সকলকে তার প্রিয় নাতি সিরাজ-উদ-দৌলা ও ইকরাম-উদ-দৌলার বিয়ের অনুষ্ঠা্নে নেমন্তন্ন করেছিলেন। অত্যন্ত জাকজমক ছিল সেই বিয়ের অনুষ্ঠান । ইকরাম-উদ-দৌলার বিয়ের অনুষ্ঠানই প্রথমে হয়। নবাবের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, এবং উপস্থিত সেনাপতিগণ ও গৃহভৃত্যদের মধ্যে এই উপলক্ষে এক হাজার খিলাত বিতরণ করা হয়েছিল। সিরাজ-উদ-দৌলার বিয়েতেও প্রদান করা হয়েছিল আরও দুই হাজার খিলা’ত এবং কোনো লোককেই একশ টাকার কম দেওয়া হয়নি। যাদেরকে এর চেয়েও বেশি টাকা দেওয়া হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজারেরও বেশি। তাছাড়া অতি বিশিষ্ট কিছু মানুষকে তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী মণি-মুক্ত প্রদান করা হয়েছিল। একমাসেরও বেশী সময় ধরে নবাবের প্রাসাদে ভোজের ব্যবস্থা লেগেই ছিল এবং সেই সঙ্গে নানা আমোদ-প্রমোদেরও ব্যবস্থা ছিল। শহরের প্রত্যেকটি পরিবারে নবাব কর্তৃক প্রস্তুত বিশেষ খাবার পাঠানো হত। বিয়ে উপলক্ষে আলোকসজ্জা ও আতশবাজির ব্যবস্থাও ছিল বর্ণনার অতীত।
কিন্তু এতো ধুমধাম করে দুই ভাইয়ের বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও কারোরই বিয়ে সুখের হয়নি। বিয়ের কিছুকাল পর সিরাজের ভাই ইকরামউদ্দৌল্লা নিঃসন্তান অবস্থায় বসন্ত রোগে মারা যান কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার সময় তাঁর এক উপপত্নী গর্ভবতী ছিল ফলে সেই উপপত্নীর ছেলেকেই ইকরামউদ্দৌলার বংশধর হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয় ,তাঁকে মুরাদ উদ্দৌলা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই মুরাদউদ্দৌলার সাথেই আবার পরবর্তী কালে সিরাজ কন্যা উম্মে জোহরার বিয়ে হয়েছিল। অপর দিকে সিরাজুদ্দৌলার বিয়েও সেভাবে সুখের হয়নি । ওমদাতুন্নিসার সাথে সিরাজের বিয়ে হলেও সিরাজ তাঁকে উপেক্ষা করেই লুতফুন্ননিসা বেগমকে নিজের জীবন সঙ্গিনী করে নিয়েছিলেন। পলাশীর বিপর্জয়ের পর ইরাজ খাঁও সিরাজ কে কোনো ভাবে সহযোগীতা করেননি। মুর্শিদাবাদে ফিরে সিরাজ যখন তার শশুড় ইরাজ খার কাছে সৈন্য সাহাজ্য চান তখন তিনিও নবাবকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
নবাব সিরাজুদ্দৌলার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে যার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত তিনি হলেন লুৎফুন্নেসা। যদিও তার শৈশবের পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। নবাব আলিবর্দীর জেনানায় এক বাঁদীর গর্ভে জন্ম হয় লুতফুন্নিসার । তার বাবার নাম জানা যায় না।নবাবী হারেমে কোনো বাঁদীর সন্তান হলে তাদের জারিয়া বলা হতো তাই লুতফুন্নিসাকে জারিয়া বা ক্রীতদাসী বলা হতো। সিরাজ তার রূপ ও গুণে এতই মুগ্ধ হন যে তিনি তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে হারেমে রাখেন এবং তাঁর নতুন নামকরণ করেন লুৎফুন্নেসা। তাদের একটি কন্যা সন্তানও হয়। ইরাজ খানের কন্যা উমদাতুন্নেসার সাথে খুব ধুমধাম করে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও লুৎফুন্নেসার ভক্তি, ভালবাসা, সেবাযত্ন ও গভীর অনুরাগ সিরাজকে এমনই আপন করে নিয়েছিল যে সিরাজ তার বিবাহিতা স্ত্রী্র চেয়েও লুৎফুন্নেসার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং লুতফুন্নিসাকেই প্রধান বেগমের মর্যাদা দেন। লুৎফুন্নেসাও অবশ্য এই মর্যাদার যথাযোগ্য সম্মান রেখেছিলেন। লুৎফূন্নেসা ছায়ার মতো সিরাজের সঙ্গ দিতেন। কি বিপদে, কি সম্পদে, লুৎফউন্নেসা কখনও সিরাজকে ছেড়ে যাননি। পলাশি যুদ্ধের পর সিরাজুদ্দৌলার আকুল আহ্বানে ও মর্মভেদী অনুনয়ে কেউই যখন তাকে অনুসরণ করেনি, তখন এই লুৎফউন্নেসাই নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে শত বিপদ মাথায় নিয়ে সিরাজের সাথে বেড়িয়ে পড়েছিলেন । অন্যদিকে সিরাজের বিবাহিত বেগম ওমদাতুন্নেসা সিরাজ মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করে নিয়েছিলেন।
নবাব সিরাজুদ্দৌলার জীবনে যে আরেকটি স্ত্রীর পরিচয় পাওয়া যায় তিনি হলেন মোহনলালের বোন মাধবী। তাঁকে হীরা বলেও ডাকা হত। বর্গী হাঙ্গামার সময় মোহনলালের এই বোনকে বর্গীরা ধরে নিয়ে যায় এবং সেই অপহৃতা ভগ্নীর খোঁজে বেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত মোহনলাল মুর্শিদাবাদে এসে পরেন এবং সিরাজউদ্দৌলার সাথে পরিচিত হন । পরে অবশ্য সেই বোনকে উদ্ধার করার পর হিন্দু সমাজে তার আর গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ফলে তাঁকে বেগম মহলে পাঠানো হয়। মোহনলালের সাথে সিরাজউদদৌলার সখ্যতার জেরে হীরার সঙ্গেও সিরাজের অন্তরঙ্গতা হয়। যদিও অনেকে মনে করেন মোহনলাল ছিলেন একজন সাধারণ সৈনিক ,কিন্তু দ্রুত সেই সৈনিক থেকে মহারাজা উপাধী,সন্মান ও ক্ষমতা পাওয়ার পিছনে ছিল এই ভগ্নীর অবদান। যাইহোক এই মাধবী বা হীরার সঙ্গে সিরাজের অন্তরঙ্গতার ফলে হীরার গর্ভে সিরাজের এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সিরাজ, হীরা ও তার পুত্রকে নিজের প্রাসাদে রাখেন ও যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করেন। নবাব আলিবর্দি খাঁ যখন সমস্ত ঘটনা জানতে পারেন তখন তিনি সিরাজের সাথে মোহনলালের বোনের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর হীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ও তাঁর নতুন নামকরণ হয় আলেয়া তারপর ইসলামিক রীতি অনুযায়ী সিরাজউদদৌলার সঙ্গে আলেয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর আলেয়াকে নিয়ে সেভাবে আর কেউ কিছু লিখে যাননি তাই তাঁর সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায়না। তবে আলেয়ার মৃত্যুর পরে তাকেও খোশবাগের নবাব পরিবারের সমাধি ক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়েছিল।
For Advertisement
Cumillar Voice’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
© Cumillar Voice ২০২৪ - Developed by RL IT BD
মন্তব্য