স্বামী-স্ত্রীর, শিখার একটা অনেক কষ্টের গল্প কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ বিকেলে দেখি একা একা আমার বউ ঢাকা এসে উপস্থিত।
৪ মে ২০২৪, ৭:২৬:৫০
স্বামী-স্ত্রীর, শিখার একটা অনেক কষ্টের গল্প কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ বিকেলে দেখি একা একা আমার বউ ঢাকা এসে উপস্থিত।
তাকে দেখে আমার তো পুরো আক্কেলগুড়ুম অবস্থা!
করি সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরি, ঢাকায় নিজেরই থাকা খাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই, সেখানে বিনা নোটিশে একজন বাড়তি মানুষ, তাও আবার মেয়েছেলে!
আমি মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড়ের সি ব্লকের একটা বাসায় সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করি। থাকি গাড়ি পার্কিং এর খোলা জায়গায় একটা সিঙ্গেল চকি পেতে। খাওয়া নিজের। খাটের নিচে কেরোসিনের চুলা আছে। চাল-ডাল আছে, নিজেরমতো করে ভাত তরকারি রান্না করে খাই।
এরমধ্যে বিনা নোটিশে ফট করে বউ’র চলে আসা নিশ্চয়ই কোনো সুখকর ঘটনা না। আমি যেখানে থাকি, সেখানে রাতভর বিভিন্ন ফ্লাট মালিকের গাড়ি যাওয়া আসা করে। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা আলো জ্বলে আর গাড়ির হর্নের প্যাঁ প্যুঁ তো লেগেই থাকে। রাতে বউকে কোথায় রাখবো, এই চিন্তা করতেই আমার গলা শুকিয়ে পুতিয়ে যাওয়া মুড়ির মতো হয়ে যাচ্ছে।
সিদ্ধান্ত নিলাম এই পাগলামির জন্য বউকে একটা কড়া ধমক দিবো। যেভাবেই হোক শক্ত কিছু কথা তাকে শোনাতেই হবে। ওমা, যতোই জিজ্ঞেস করি, “এভাবে ঢাকা চলে আসছো কেন? ঘটনা কী?” সে কিছুই বলে না, আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু ভ্যেঁ ভ্যেঁ করে কাঁদে। ভারী মসিবত!
এই মেয়ের মধ্যে শিং মাছের স্বভাবটা প্রকট। শিং মাছ যেমন মাথা দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে মাটির মধ্যে ঢুকতে থাকে, ঢুকতেই থাকে, এই মেয়েও আমাকে কাছে পেলে মাথা আর নাক দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে বুকের মধ্যে ঢুকতে থাকে। আমার বুকটা যেন তার নিরাপদ নরম কাদা-মাটির বিল। সবসময়ই সে এমন করে। এক পর্যায়ে আমি যাই আবেগী হয়ে। পাছে শক্ত কোনো কথা আর বলা হয়ে ওঠে না।
সত্যি কথা বলতে কী, অনেকদিন পর নুসরাতকে কাছে পেয়ে আমারও খুব ভালো লাগছে। কতদিন পর চাঁদমুখটা দেখছি! দুই মাস আগে বাড়ি থেকে এসেছি, এরমধ্যে আর যাইনি। বাড়ি যাওয়া আসার গাড়ি ভাড়া দিতেই বেতনের বড়ো একটা অংশ শেষ হয়ে যায়, এইজন্য তুমুল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেতে পারি না।
তারপরও অনেক চেষ্টা করে মুখে রাগী রাগী ভাবটা ধরে রেখেছি, কারণ এইসব পাগলামিকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। কিন্তু কিছু যে বলবো, তারও তো কোনো উপায় নেই। এমন পশমি বিড়ালের মতো আদুরে একটা মেয়েকে কি চোখ রাঙিয়ে শক্ত কিছু বলা যায়? যতো যাই করুক দিনশেষে সে আমার শিং মাছ।খুব নিজের একটা শিং মাছ। আর তাছাড়া এতো দূর থেকে এসেছে, নাওয়া খাওয়াও তো হয়নি নিশ্চয়। এখন থাক, পরে সুযোগ বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
ব্যাগপত্র খাটের নিচে রেখে নুসরাতকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে কেরোসিনের চুলায় ভাত চড়িয়ে দিলাম। ভাতের মধ্যে দুইটা আলু আর একটা ডিম দিলাম। কড়াইতে এক মুঠ ডাল ধুয়ে রাখলাম। ভাত হয়ে গেলে ডাল তুলে দিবো। একটা আলু দিয়ে আলু-ডিম ভর্তা, আর আরেকটা সিদ্ধ আলু ডলে ডালের মধ্যে দিয়ে দিবো। শুকনা মরিচে চালতা আর আলু দিয়ে রান্না করা ঘনো ডাল নুসরাতের খুব পছন্দ। সাথে পাতে খাওয়ার জন্য একটা কাগজি লেবু।
সিঁড়ির নিচে যেখানে পানির মটরটা রাখা, ওখানে বিছানার চাদর টানিয়ে একটা দেয়ালের মতো দিয়ে অস্থায়ী ডাইনিং রুম বানিয়ে নুসরাতকে খেতে দিলাম। তার খাওয়া দেখেই বুঝতে পারলাম দুপুরে পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। সকালেও হয়তো কিছু খায়নি।
জার্নি করার আগে সে কিছু খেতে পারে না। ওর বাপের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র কুড়ি মাইলের মতো দূরে। আমাদের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট থানায় আর ওর বাড়ি চিতলমারী থানায়। এইটুকু মাত্র দূরত্ব তারপরও বাপের বড়ি বেড়াতে যাওয়ার সময় কিছু খায় না সকালে।
বসন্ত কাল। সবে গরম পড়তে শুরু করেছে, এখনো গুমোট গরমটা পড়া শুরু হয়নি, তবে সিঁড়ির নিচে আটকা জায়গা হওয়ায় কিছুটা গরম লাগছে। হাল্কা গরমে নুসরাতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। দেখতে এতো ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে কপালে কয়েকটা মুক্তার পুথি সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
টকটকে ফর্সা কপালে সেই মুক্তা ঝিকমিক করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে রাস্তার শেষ মাথার আনকোরা দুবলা ঘাসে সকালের স্নিগ্ধ শিশিরকনা জমে আছে। আমি অপলক তার দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে সে মানবী না, আসমানের একটা কিশোরী পরী, যে তার বাবা মার সাথে কোহেকাহাফ নগরীতে যাওয়ার সময় পথ ভুলে মোহাম্মদপুরে চলে এসেছে।
নিজে দুই এক গাল খাচ্ছে আবার আমার মুখেও তুলে দিচ্ছে। আমার এতো আনন্দ হচ্ছে! আনন্দে আমার চোখে পানি চলে আসছে বারবার। চোখের পানি আড়াল করতে গেলে মেয়েটাকে দেখা হয় না, এই ভয়ে আড়াল করতে পারছি না। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ শিং মাছটাকে চোখের তারায় করে রাখি, কিন্তু গরিবের সখ আর সাধ্য দুইটা দুই মেরুর জিনিস।
নুসরাত আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। আমার সারা গায়ে অদ্ভুত একটা শিহরণ ছড়িয়ে পড়লো বিদ্যুতের গতিতে। আমার কাছে মনে হলো, এমন একটা স্পর্শের জন্যই হয়তো মানুষ তার জীবনে এমন একজনকে চায়। খুব নিজের একজন, শুধুমাত্র যার একটা ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে মানুষ আজরাইলের সামনে দাঁড়িয়েও মৃত্যকে পাশ কাটিয়ে আরেকটু সময় বাঁচতে চায়।
মাযহার ভাই না আসলে এভাবেই হয়তো সময় এগিয়ে যেতো। সকালে সে তার মালিকের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গিয়েছিলো সাভার। এই বাসার চার তলার ফ্লাট মালিকের গাড়ি চালায় এই লোকটা। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়ায়। পরিবার নিয়ে থাকে ডি ব্লকের একটা আধাপাকা টিনসেড ঘরে। এই বাসায় চাকুরি নিয়ে আসার পর থেকে তার সাথে আমার খুব ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে। নুসরাতের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওর অনেক গল্পই করেছি মাযহার ভাইর সাথে, সুতরাং দেখামাত্রই চিনে ফেলেছে।
সন্ধ্যায় মাযহার ভাইকে গেটের দায়িত্ব দিয়ে নুসরাতকে নিয়ে গেলাম সংসদ ভবনের সামনে। আনন্দে সে যেনো ঝলমল করছে। যা দেখছে তাতেই অবাক হচ্ছে। মুড়ি মাখা, ফুসকা, চটপটি, যা খাচ্ছে তাই তার মনে ধরছে। এইটা কী? ওইটা কী? এতো জ্যাম কেন? এতো গাড়ি কেনো? এইসব প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলছে আমাকে।
সবচেয়ে মজা লাগছে তার রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপারটা দেখে। এক পা সামনে বাড়িয়ে গাড়ি দেখে আবার পিছনে ফিরে আসে! আবার এক পা সামনে দিয়ে ফিরে আসে। সাড়াসির মতো শক্ত করে ধরে আছে আমার হাত, ভাবখানা এমন যেন এই হাতটা শুধু তার। একবারে নিজের। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া অন্যকিছু আর এই হাতের বাঁধন ছুটাতে পারবে না।
পূর্ণিমা রাত। আকাশে থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে। আকাশ জুড়ে আলোর মাখামাখি অবস্থা। সেই আলো ঠিকরে পড়ছে চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকের পানিতে। আমি আর নুসরাত বসে আছি লেকের পাড়ে বাঁধানো পাকা পাড়ে। গুনগুন করে গাইছি, “এই মায়াবী চাঁদের রাতে, রেখে হাত তোমার হাতে, মনের এক গোপন কথা তোমায় বলতে চাই….”
আরো কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু গেটে বসিয়ে রেখেছি মাযহার ভাইকে। বেচারা সারাদিন গাড়ি চালিয়েছে, এখন তার একটু বিশ্রাম দরকার। এইজন্য আবার বাসার দিকে রওনা দিলাম। আসার পথে শিং মাছটাকে একটা শাড়ি কিনে দিলাম। ভেতরটা পুরো কালো আর দুই পাড় লাল ।আমি নিশ্চিত, এই শাড়ি পরা অবস্থায় কোনো পরি যদি তাকে এক পলক দেখে, তাহলে নিশ্চিত পরিটা লজ্জায় আত্মহত্যা করবে।
বিকেলে রান্না করে রেখেছিলাম। নুসরাতের খাওয়ার পরও যা অবশিষ্ট আছে, তা আমাদের দুজনের হয়ে যাবে। নইলে বাইরে খাওয়া যেতো। শুনেছি বিহারি ক্যাম্পের বোবার বিরিয়ানি নাকি খুব সুস্বাদু, দামও নাগালের মধ্যে। খাইনি কখনো। বউকে নিয়ে খেতে হবে কাল।
রেসিডেন্সিয়াল কলেজের পাশ দিয়ে হেটে হেটে তাজমহল রোডের দিকে যাচ্ছি আর মনেমনে ভাবছি, রাতে নুসরাতকে নিয়ে থাকবো কোথায়? প্রথমবার ঢাকায় এসেছে,ওকে একা একা তো কোথাও রাখা যাবে না। কিন্তু আমি যেখানে থাকি, বউ নিয়ে সেখানেও তো থাকা যায় না।
সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িওয়ালা কিংবা উনার স্ত্রীকে বললে অবশ্যই একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। তারা পুরো ফ্লোর নিয়ে থাকে। দুইটা রুম ছাড়া বাদবাকি রুমগুলো সব একবারে ফাঁকা পড়ে থাকে। কয়েকবার গিয়েছি তাদের বাসায় বিভিন্ন কাজ করতে, তখন দেখেছি। একটা রাতেরই তো ব্যাপার। তারা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝবেন।আর গেটের দায়িত্বটা এক রাতের জন্য মাযহার ভাই কিংবা অন্য কাউকে দিবো।
বাসায় ফিরে প্লানটা মাযহার ভাইকে বললাম। সবকিছু শুনে সে একটা হাসি দিয়ে বললো ঠিকাছে, আমি এখন যেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমাই। এগারোটার দিকে এসে গেটে বসবো। আপনি বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে নিয়েন এরমধ্যে। আর কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে খবর পাঠায়েন। এই বলে সে বাসায় চলে গেলো।
দুইবার কলিং বেল টেপার পর বাড়িওয়ালার কাজের মহিলা দরজা খুলে দিলো। সে খুব ভালো মানুষ। তার সাথে নুসরাতকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সবকিছু খুলে বললাম। সবকিছু শুনে সে মুখটা মলিন করে বললো ভেতরে আইয়্যা বহেন,আম্মারে ডাইক্যা দিতাছি।
বাড়িওয়ালি মহিলা আসলে আমরা দুইজন দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিলাম। এর আগেও কয়েকবার এ বাড়িতে এসেছি বিভিন্ন কাজকামে, কিন্তু কখনো সোফায় বসিনি। আজ বউ এসেছে সাথে, এইজন্য বসেছি। ড্রইংরুমের সোফায় বসার ব্যাপারটা যে তার মোটেও ভালো লাগেনি, তা তার মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতে পেরেছি।
সবকিছু শুনে বাড়িওয়ালি সোজা বলে দিলো তার বাসায় আমাদেরকে থাকতে দেওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। আর এ বাড়িতে সিকিউরিটির চাকুরি দেওয়া হয়েছে আমাকে, বউ নিয়ে রংতামাশা করতে নয়। এইভাবে চললে সিকিউরিটির জন্য তারা অন্য কাউকে দেখবে।
আমি একবার বাড়িওয়ালির মুখের দিকে আরেকবার বুয়ার মুখের দিকে তাকালাম। বুয়ার মুখটাও অন্ধকার হয়ে আছে আর বাড়িওয়ালির মুখটাও। তবে তফাত হলো, তারটা বিরক্তি আর ঘৃণায় আর বুয়ারটা দুঃখে। তার মতো অন্য একজন গরীব মানুষের দুঃখে।
অন্যের অপমান আর দুঃখ দেখে আমাদের হাসি আসে, তবে যাদের হাসি আসে না,বরং দুঃখ লাগে তারা সাধারণ কোনো মানুষ নয়, অতিমানব। একই সৃষ্টি মানুষ, অথচ সেই মানুষে মানুষে কতো ব্যবধান!
নুসরাতের চোখে পানি টলটল করছে। যেন টিনের চালে বৃষ্টি জমে আছে, আকাশ থেকে আরেকটা ফোটা পড়লেই তার সাথে মিশে গড়িয়ে পড়বে। তার হাত ধরে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলাম। লজ্জা আর অপমানে আমি ঠিকমতো পা ফেলতে পারছি না। আমার কাছে মনে হলো, পৃথিবীতে গরীব হয়ে জন্মানোর চেয়ে বড়ো পাপ আর কিছু নেই।
ড্রাইভার এবং অন্যান্য মানুষের কাছ থেকে শুনেছি এই বাড়িটার মালিক ছিলো বাড়িওয়ালার বাবা। পৈত্রিক সূত্রেই মালিকানা পেয়েছে এই মহিলার স্বামী। অর্থাৎ, এখানে তার নিজের কোনো মুনশিয়ানা নেই। এখানে এই লোক যদি তার ধনী বাবামা’র ঘরে জন্ম না নিয়ে আমার মতো গরিব ঘরে জন্ম নিতো?
নুসরাতের কাঁধে আমার হাত। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতেই সিদ্ধান্ত নিলাম আল্লাহ চায় তো একদিন এরচেয়ে ভালো একটা বাড়ির মালিক হবো। এবং তারজন্য যতো পরিশ্রম করতে হয় করবো। তারপর যেভাবেই হোক এই মহিলাকে এই রাতের কথা মনে করিয়ে দিবো।
নুসরাত পুরো অসাড় হয়ে আছে। একটা কথাও সে আর বলেনি। নিচ তলায় নামার আগে আমি তার মাথায় হাত রেখে মনের কথাটা বললাম। সে বোটা খসা ফলের মতো আমার বুকের মধ্যে টলে পড়লো। আমি মাথায় কয়েকটা চুমু দিলাম। স্বামীর এমন অপমানে নিশ্চয় তার বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কাঁদছে। কাঁদুক, কেঁদে কেঁদে বুঝুক যে, পৃথিবীটা এতো সোজা কোনো জায়গা না। গরিব মানুষ হয়ে জন্মানোটা কতো বড়ো পাপ, তার কিছুটা সেও অনুভব করুক।
সিদ্ধান্ত নিলাম রাতে মাযহার ভাই আসলে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে বউকে নিয়ে এখানে বসে বাড়ি-গাড়ি পাহারা দিবো। সিকিউরিটি গার্ডের বউও এক রাতের সিকিউরিটি গার্ড। সারারাত দুইজনে গল্প টল্প করে কাটিয়ে দিবো। সকালে একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে, তখনো মাযহার ভাই আসেনি। আমি আর নুসরত চুপচাপ বসে আছি চকিটার উপরে। নুসরাত কোমল হাতে আমার হাতটা ধরে বললো আমি এভাবে এসে তোমাকে খুব বিপদে ফেলে দিলাম। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সবকিছুর জন্য আমি লজ্জিত। লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি মেয়েটার কাঁধে হাত রাখলাম। যার অর্থ হলো, ” জনম জনম তব তরে কাঁদিবো।”
অনেক্ষণ পর নুসরাত বললো, তোমার মন তো এখন খুব খারাপ, ভালো করে দেই? ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি,আমাদের দুজনের মন ভালো করার একটা ওষুধ আছে, তবে সেটা নিতান্তই আমাদের দুজনের। খুব গোপন একটা ব্যাপার। আমি বললাম, এখন? “সারাক্ষণ শুধু মাথায় আজেবাজে চিন্তা!” এই বলে সে আমার বুকে একটা কিল দিয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে নরম সুরে কানেকানে বললো, তার গর্ভে আমাদের ভালোবাসাবাসির প্রথম ফুল ফুটেছে।
গতকালই সে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পেরেছে। এই মহা খুশির খবরটা নিজের মুখে দিতেই সে ঢাকায় ছুটে এসেছে। তার কথাটা শোনার পর আমি নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করাতে পারলাম না। মনে হলো পৃথিবী এখানে থমকে যাক, সময় থেমে থাকুক। শুধু এই একটা কথা আমার কানে বাজতে থাকুক জনম জনম ধরে।
বারোটার দিকে মাযহার ভাই আসলো। এসে একটা চাবির রিং আমার হাতে দিয়ে বললো, ভাবিকে নিয়ে আজ রাতে আমার বাসায় থাকেন আপনারা। আলেয়া বুয়া আমার মালিকের বাসার টেলিফোন থেকে আমাকে ফোন করে সবকিছু জানিয়েছে। বাড়িওয়ালার ব্যাপারে আমি আগেই এমনটা আশংকা করেছিলাম। কোনো অসুবিধা নেই ভাবি, দুইজনে ভালোমতো থাকতে পারবেন গারিব এই ভাইটার ঘরে।
আমি বললাম, আপনার তো একটাই রুম। আমরা গেলে ভাবির অসুবিধা হবে। সে বললো, তাকে বসিলায় তার ভাইয়ের বাসায় রেখে এলাম মাত্র। এইজন্যই তো দেরি হলো আসতে।
জাপান সিটি গার্ডেনের সামনে দিয়ে হেটে হেটে মাযহার ভাইর বাসার দিকে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট একবারেই ফাঁকা। দিনের বেলায় গাড়িঘোড়ার জন্য বোঝা যায় না, দুই পাশের পুরো রাস্তা এক করে দেখলে অনেক চওড়া লাগে রাস্তাটা। জোছনার আলো থৈথৈ করছে। বউ শক্ত করে আমার হাত ধরে পাশাপাশি হাটছে। তার গায়ের সাথে আমার গা’র ঘসা লাগছে। নিজের মানুষটার এই স্পর্শ পৃথিবীর যেকোনো সুখানুভূতির চেয়ে স্নিগ্ধ, সুন্দর।
মাযহারর ভাইর কথা যতোবার মনে পড়ছে, ততোবারই বুক ফেটে কান্না আসছে। মনে মনে চিন্তা করছি, আজ আকাশে কী উথাল পাথাল জোছনা উঠেছে ! এই জোছনা নিয়ে মানুষের কতো মাতামাতি!
মানুষ এই জোছনার আলো দেখতে কাড়িকাড়ি পয়সা খরচ করে সমুদ্রে যায়, পাহাড়ে যায় আবার কেউ কেউ বনে-জঙ্গলে চলে যায়, অথচ আমাদের চারপাশে মাযহার ড্রাইভারের মতো কিছু মানুষ বুকে এমন হাজারটা আকাশের সমান জোছনার আলো নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আমরা তাদেরকে দেখি না কেনো?
Cumillar Voice’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।