দীর্ঘ ১৫ বছর লন্ডন শহরে কাটিয়েছি। লন্ডনের অলিগলিসহ রাজবাড়ি থেকে মুচির দোকান পর্যন্ত; এমনকোনো জায়গা নেই- যেখানে আমার পায়ের ছাপ পড়েনি। নতুন শহর। নতুন দেশ। যদি নতুন কিছু শিখি।
৬ মে ২০২৪, ৫:২৪:৪৭
দীর্ঘ ১৫ বছর লন্ডন শহরে কাটিয়েছি। লন্ডনের অলিগলিসহ রাজবাড়ি থেকে মুচির দোকান পর্যন্ত; এমনকোনো জায়গা নেই- যেখানে আমার পায়ের ছাপ পড়েনি। নতুন শহর। নতুন দেশ। যদি নতুন কিছু শিখি।
অনেক কিছু দেখার মাঝে এক জুতো পলিশওয়ালা দেখেছি। যাকে কথ্য বাংলায় মুচি বলি। লিভারপুল স্ট্রিট আন্ডার গ্রাউন্ডে এক সাদা ইংরেজ সে। আমার মনে হয় সে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মুচি। কোনো কথা নেই মুখে। চোখ ঠিক জুতোতে। একমনে পলিশ করে চলেছে। মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাজে সে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছে। কেউ-কেউ জুতো না খুলেই পা রাখছে তার সামনে। সে তার মুখের দিকে না তাকিয়েই একমনে তার কাজ করে চলেছে। দেখে যেনো মনে হয় একজন ঝানু শিল্পী ছবি আঁকছে একমনে। অনেকবার দাঁড়িয়েছি, দেখেছি তার এই শিল্পকলা অবাক বিস্ময় নিয়ে। আমি তখন লিভারপুল স্ট্রিট বার্গারকিং-এ কাজ করি। একজন সেলস ম্যান হিসেবে। বলতে গেলে আমার মত হাজারের ওপর বাঙালি সেখানে কাজ করে নানা ফুড সপে। আমার ইচ্ছে হত, ইশ! আমি যদি ওই জুতো পলিশওয়ালার মতো হতে পারতাম! সারাদিন একমনে জুতো পলিশ করে যেতাম। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। কেন নয়? ওই যে পাছে লোকে কিছু বলে। আমি জুতো পলিশ করছি শুনে বন্ধুরা সবাই রে রে করে উঠবে। তারপর আবার ওখানকার কাউন্সিল থেকে পারমিট বের করতে হবে। দেখাতে হবে ওই কাজটায় দক্ষ আমি। বিজনেস লাইসেন্স। একখণ্ড জায়গার লিজ। ম্যালা হাঙ্গামা।
.
একদিন সময় করে সাহস নিয়ে গিয়েছিলাম সেই জুতো পলিশওয়ালার কাছে, তার সাথে আলাপ করতে। খুব গম্ভীর মানুষ সে। মনে হয় তার ঠোঁটদুটো এমনভাবে সেলাই করা; যেন তার ফাঁকগলে কথা বের হবার কোন উপায় নেই। অভিবাদন জানিয়ে সরাসরি জানতে চাইলাম তার নাম। সে প্রথমে দেখলো আমায়। ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি মিশিয়ে নাম বলল, জাস্টিন। আমি যেচে শুরু করে দিলাম আলাপ। খুব ভদ্রলোক সে। কোন প্রশ্ন করে না। শুধু উত্তর দেয়। জানলাম এটা তার ফ্যামিলি বিজনেস। বাপ্ও এই কাজ করেছেন। এমনকি তার দাদাও। সে থাকে নটিংহিল গেট-এ। মানে পশ এরিয়াতে। তার একটিই মেয়ে- পড়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাস্টিন বছরে নয়মাস কাজ করে। বাকিসময় কাটায় ফ্রান্সে। মাঝে-মাঝে সে তার বোনের কাছেও যায় স্পেনে। বছরে একবার যায় সাউথ আফ্রিকার জঙ্গলে। কাজের সময় হয়ে আসছে। সময় নেই হাতে। তাই যতখানি বিস্ময় নিয়ে তার সাথে আলাপ শুরু হয়েছিল; আলাপটি শেষ হল তার দ্বিগুন বিস্ময় নিয়ে।
.
আমরা বাঙ্গালীরা কাজের ন্যূনতম মূল্য, সন্মান বা মর্যাদা দিতে শিখি নি। শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে বাঙালি জাতির দৃষ্টিভঙ্গি উপনিবেশিক এবং নিকৃষ্টতম! শ্রমের যে মূল্য আছে, মর্যাদা আছে পাঠ্যপুস্তকে পড়া সত্ত্বেও কর্মজীবনে তা বেমালুম ভুলে যায়। অশিক্ষিত বাঙালিদের চেয়ে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত বাঙালির মধ্যে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। বড়লোকি, মধ্যলোকি ও ছোটলোকি নামে কাজকে বিভক্ত করেছি আমরা। সম্ভাবত সেই মানসিক সমস্যার কারনেই আমাদের দেশে কাজের পরিধি সংকীর্ণ। সবাই বড় অফিসার হতে চায়। কেউই ছোট কাজ করবে না। সুতরাং মেধাহীনরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করে কম্পিটিশন বাড়ায়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি সবার জন্য না। লন্ডনে দেখেছি উচ্চ শিক্ষা শুধু গুটি কয়েক মানুষের জন্য, সেখানকার মানুষ এ লেভেল (ইন্টারমিডিয়েট) পাস করলেই শিক্ষিত হয়ে যায়।
বাঙালীর সস্তা সেন্টিমেন্ট আর মানুষিকতার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। চুরি করতে লজ্জা হয়না, হালাল ছোট কাজ করলে ইজ্জত চলে যায় এদের।
Cumillar Voice’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।