আজ প্রায় ১০ বছর পর বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম।
১৫ জুন ২০২৪, ১:১০:২২
আজ প্রায় ১০ বছর পর বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম।
জীবনের কালো অধ্যায় ভুলতে পারি জমিয়েছিলাম দুবাইতে। না ফেরার ইচ্ছা নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু মার কান্নাকাটিতে আজ দুবাই থেকে দেশে ফিরতে হলো।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখলাম আমাকে রিসিভ করতে এসেছে আমার ছোট বোন আর আমার কৈশরের ভালোবাসার মানুষ তাহমিদ যে একসময় আমায় পাগলের মত ভালবাসতো কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আজ সে আমার ছোট বোনের জামাই। ওদের সাথে কুশল বিনিময়ের পর বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম। ছোটবোনের বাচ্চার আকিকা অনুষ্ঠান উপলক্ষে মা কান্নাকাটি করে নিয়ে আসলো দেশে।
গাড়িতে বসেই ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসলো ঘুম হলে ভালো হতো, কিন্তু চোখ বুজতেই কালো অতীতটা সামনে এসে দাড়ালো।চোখে ভেসে উঠলো সেসব দিনের কথা যে দিনগুলো এক কিশোরীর থেকে কেড়ে নিয়েছিল আনন্দ, বানিয়ে দিয়েছিল হিংস্র,যে নিজ হাতে শেষ করে দিয়েছিল নিজের স্বামী এবং সন্তানকে।
আমি মুনতাহা হোসাইন। বাবা মার বড় মেয়ে আমি।আমরা তিন বোন। আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট সেঁজুতি,যে আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে এসেছে আর পরের বোনটা আমার থেকে বেশ ছোট ওর নাম মাইমুনা। কদিন আগেই বিয়ে হয়েছে।ছোট থেকেই খুব চঞ্চল ছিলাম আমি। ঘরে তো মোটেই থাকতাম না সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম বাইরে বাইরে। যখন আমার 12 বছর বয়স তখন এক যুবকের পাগলামোর মোহে পড়ে গেলাম,কৌতুহল হত প্রেমের প্রতি।
তার পাগলামো দেখাতেই সীমাবদ্ধ থাকতাম কারণ তার পাগলামিতে সাড়া দেয়ার মতন অত সাহস ছিল না। হাজারটা চিঠি পেতাম তার থেকে,বেশিরভাগ চিঠিতেই লেখা থাকতো “তোমাকে আমার করে না পেলে আমি বাঁচতে পারব না”।সেই মানুষটিই হলো তাহমিদ।
এর মাঝেই আমার দাদু খুব অসুস্থ হয়ে পরলো আর তার ইচ্ছে তার একমাত্র ছেলের ঘরের নাতিনের বিয়ে দেখে যাবে,নাহলে সে মরেও শান্তি পাবে না।তখন আমার বয়স মাত্র ১৪ বছর কিন্তু তবুও দাদি বাবার কাছে আবদার করে বসল যে আমার বিয়ে তার পছন্দের ছেলে মাহবুবের সাথে দিতে হবে আর সেটা খুব দ্রুত।কিছু বুঝে উঠার আগেই এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেলল।
মাহবুব আমাদের এক গ্রাম পড়ে থাকে আমাদের বাড়িতে বেশ আসা-যাওয়া ওদের পুরো ফ্যামিলির।কিন্তু ওই লোকটাকে আমি মোটেও পছন্দ করিনা কারণ মাস দুয়েক আগে একদিন আমাদের বাড়ির পেছনে আমার সাথে খারাপ আচরণ করতে চেয়েছিল কিন্তু আল্লাহর রহমতে কিছুই করতে পারেনি।ওর সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে কেমন গা ঘিনঘিন করছে, মাকে বেশ কয়েকবার বলতে চেয়েছি কিন্তু আমার কথা শুনতে চাই না,শুধু বললো- পরিবারের মান রাখতে শেখো।”
বাধ্য মেয়ের মত সব মানতে থাকলাম আর আশায় থাকলাম হয়তো তাহমিদ কিছু করবে, ওতো আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না, দেখতে দেখতে গায়ে হলুদের দিন এসে গেল। হলুদের অনুষ্ঠানে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে তাহমিদ আর ওর পুরো ফ্যামিলি ছিল, বারবার আমি তাহমিদের দিকে তাকাচ্ছিলাম কিন্তু ও খুব স্বাভাবিক ছিল।
এরপরের আমার চোখের সামনে যা দেখলাম তাতে আমার নিঃশ্বাস মনে হচ্ছিলো আটকে যাচ্ছে…তাহমিদ মেহমানদের ভিড় পেরিয়ে আমার ছোট বোন সেঁজুতির পাশে গিয়ে তার হাতটা ধরে তাতে ছোট্ট করে চুমু দিল। আর আমার বোন তাকে কিছুই বলল না! একি আমার সেই বোন যে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।যে তাহমিদের সম্পর্কে সব জানতো! আমার চেয়ে এক বছরের ছোট সেঁজুতি, দুজন সারাদিন একসাথে থাকতাম একজন আরেকজনের কাছে সব কথা শেয়ার করতাম,” দুই শরীর তবে এক আত্মা এমন সম্পর্ক আমাদের।আর আজ তার কাছে থেকে এমন ধোঁকা পেয়ে আমার দুনিয়াটা থমকে গেলো, কাউকে কিছুই বলতে পারলাম না। মা-বাবা আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছে,আপন বোন ধোঁকা দিলো এই দুনিয়ায় আমার আপন আদৌ কি কেউ আছে?
এসব ঘোর কাটানোর আগেই বিয়ে টা হয়ে গেল।
স্বাভাবিক ভাবেই সব মেনে নিলাম, ভাবলাম জীবন নদীর স্রোতের সাথে চলতে থাকি দেখি মহান আল্লাহ তায়ালা কি ভাগ্যে রেখেছেন। কিন্তু আমার এই চুপ থাকার কারণে আমি নিজের কপালে কি টেনে আনলাম তা বুঝতে আমার অনেক টাই সময় লেগে গিয়েছিল। যখন বুঝলাম তখন স্রোতের বিপরীতে চলার মত কোন পথ আর আমার সামনে খোলা ছিল না।
গাড়ি থামতেই অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলাম।বাড়িতে পৌঁছে গেছি। গাড়ি থেকে নামতেই আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম পাড়া-পড়শি আমার দিকে কেমন যেন ভয়ার্ত এবং তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কেনইবা তাকাবে না! তাদের সামনেই যে নিজ সন্তানকে হত্যা করেছিলাম।
সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি পুরো বাড়ি আত্মীয়-স্বজনে ঠাসা। সেঁজুতিকে জিজ্ঞাসা করতেই ও বলল ‘আরে অনুষ্ঠান তো এ বাড়িতেই হচ্ছে, তাহমিদদের বাড়িটা রং করা না,আবার অনেক সেকেলে টাইপ তাই এখানেই করছি।
আমি আর কথা বাড়ালাম না খুব ক্লান্ত লাগছিলো তাই ঘরে দিকে যাচ্ছিলাম আর তখনই মা ও বাবা ভেতর থেকে আসলেন। দশ বছর পর বাড়িতে ফেরায় বাবা মাকে দেখে আমার যতটুকু ইমশোনাল হওয়ার কথা ছিল না আমি ততটা হলাম না আমার ফ্যামিলি। তবে মাকে এতটা স্বাভাবিক দেখে অবাকই হলাম কারণ গত দুমাস ধরে যতবার ফোন দিয়েছি ততবারই মা কান্নাকাটি করে আমাকে বাংলাদেশে আসতে বলেছে।
আমি তো ভেবেছিলাম অন্তত একবার বুকে টেনে নিবেন কিন্তু মা স্বাভাবিক ভাবেই বলল- যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেও,আর গাড়ি থেকে বাকি ব্যাগ আনতে আমি কাউকে পাঠাচ্ছি। আর কোন ব্যাগ নেই মা এই একটাই ব্যাগ, পনের দিনের জন্য কত কাপড়ই আর লাগবে। মানে এই ব্যাগে শুধু ই কাপড় নাকি?বাড়ির কারো জন্য কিছু আনিসনি?
আসলে মা প্লেন টিকেট নিজের টাকায় কাটতে হয়েছে তো তাই কাছে বেশি টাকা নেই। মা মনে হয় রাগ হলেন।
আমাকে ঘরে যেতে বলে মা উঠানে চলে গেলেন। ঘরে গিয়ে নিজ মনে ভাবতে লাগলাম যে- কেন আমি মাকে বলতে পারলাম না যে আমি প্রায় ৭৫ কেজি জিনিস জাহাজে পাঠিয়ে দিয়েছি যা তিন চারদিন পরই আমাদের বাড়ির পাশের কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে পৌঁছে যাবে। মায়ের অদ্ভুত ব্যবহারের কারণে?
ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঘরে আসলাম তখন মা ও ঘরে আসলেন বললেন- একটা স্বর্ণের চেইন আনতে বলেছিলাম আনতে পারছিস নাকি টাকা ছিল না? মায়ের কথার জবাব না দিয়ে চেইন টা বের করে মায়ের হাতে দিয়ে দিলাম।
তুই সেঁজুতির মেয়েকে কি দিবি? মানে? মানে চেইন তো আমি দিব বলে আনিয়েছি,অনুষ্ঠান উপলক্ষে এসেছিস তুই নিজে দেওয়ার জন্য তো কিছু আনবি!
মা বাংলাদেশে এসে খরচ করার জন্য টাকা তো তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি তুমি কিছু কিনে দিও। তোর কথাবার্তার কোনো মানে আমার বুঝে আসেনা।একে তো খালি হাতে দেশে এসে পড়েছিস,কারো জন্য কিছু আনিসনি। সামান্য কিছু গিফট তো আনতে পারতি। মানুষের ছেলেমেয়েরা বিদেশ থেকে কত কিছু আনে,আর তুই? তাঁরা ও টাকা খরচ করে পাঠায় আমিও টাকা খরচ করেই পাঠাইছিলাম। কপালটাই খারাপ আমার।
মেয়ে দুবাইতে বড় হোটেলে বড় চাকরি করে আর আমি টাকার কষ্টে শখ পূরণ করতে পারিনা।বলি বেতন তো কম পাসনা সব কি ঐ দেশে খেয়েই উড়িয়ে দিস নাকি? মা এসব কেমন কথা বলছো তুমি? নিজের খাওয়া খরচ রেখে বাকিটা তোমাদের পাঠিয়ে দেই।আর শখের কথা বলছো তোমরা তো নিজেদের শখ পূরণ করতে আমাকে দুবাই পাঠাওনি,আমি নিজের অতীত ভুলতে এদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।আর টাকার কথা তুই কি খোটা দিচ্ছিস?
মা আমার কথার উল্টো অর্থ কেন বের করছো? হয়েছে কটা টাকা কামাই করে এত বড় কথা বলছো, তোমার বাবা নিজের জমিজমা বিক্রি করে তোমাকে বিদেশে পাঠিয়ে ছিল, ভুলে যেওনা সে কথা।
মা খুব রাগের সহিত ঘর থেকে চলে গেলেন। অথচ যত টাকা খরচ করে তারা আমাকে দুবাই পাঠিয়ে ছিল তার কয়েক গুণ বেশি টাকা আমি তাদের ফেরত দিয়েছি এটা জানা সত্ত্বেও যে তারা কোন জমি বিক্রি করে আমাকে দুবাই পাঠায়নি বরং আমার শশুর বাড়ির সব আসবাবপত্র ও শাশুড়ির গহনা বিক্রির টাকা দিয়ে পাঠিয়েছে।যা আমি দুবাই যাওয়ার দুই তিন বছর পর জানতে পারি।মা ভেবেছে আমি এখনো কিছু ই জানিনা। দুনিয়ার সব মা বাবাই কি এমন হয় নাকি শুধু আমার কপালটাই খারাপ? চলবে……
জীবনের_কালো_অধ্যায়
সূচনা পর্ব।
ফাহমিদা হোসাইন।
Cumillar Voice’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।