দার্জিলিংয়ের ঘুম রেল স্টেশনের বাঁহাতের রাস্তা ধরে সুখিয়াপোখড়ি। 

৩০ জুলাই ২০২৪, ৭:৪৩:২৩

দার্জিলিংয়ের ঘুম রেল স্টেশনের বাঁহাতের রাস্তা ধরে সুখিয়াপোখড়ি যখন পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন প্রায় রাত্রি আটটা।
পাহাড়ের আটটা মানে সমতলের রাত্রি এগারোটা বারোটা। সুখিয়াপোখড়ি থেকে শিলিগুড়ির বাড়ি পৌঁছতে মিনিমাম সাড়ে এগারোটা বারোটা বাজবে।  এত রাত্রের এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে পাহাড়ে রাইড করা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বুঝে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।  কিন্তু থাকবো কোথায় ?   শুনেছিলাম সুখিয়াপোখড়ি আর নেপালের পশুপতি মার্কেটের মাঝামাঝি জায়গায় রঙভং নামে একটি সুন্দর জায়গা আছে, সেখানেই রাত্রিটা কাটিয়ে দেব ঠিক করলাম, কিন্তু নিশ্চিতভাবে জায়গাটা চিনি না।  সুখিয়াপোখড়ি বাজার শেষ করে মিরিকের রাস্তা ধরলাম, এই রাতেও কয়েকটা মানুষের জটলা চলছিল, জিজ্ঞেস করতেই বলল, “সিমানা ভিউপয়েন্ট থেকে আর কিছুটা এগোলেই বাঁদিকে একটা রাস্তা নেমে গেছে, সেই রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার এগোলাই রঙভং পেয়ে যাবেন”।  রাস্তা তো ডানদিকে বাঁদিকে অনেকগুলোই নেমেছে, কিন্তু কোন রাস্তাটা রঙভং গিয়েছে কীভাবে বুঝবো ভাবতে ভাবতেই বাইক ষ্টার্ট করে স্পিড তুললাম।  রাস্তার বাঁদিকের খাদের নিচ থেকে মাথা উঁচু করে মনুমেন্টের মতো লম্বা লম্বা পাইন গাছগুলো ডালপালা বিস্তার করে চাঁদের আলোকে ঢেকে দিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।  রাস্তায় ব্যস্ত মেঘেদের আনাগোনা।  জনমানবশূন্য নিস্তব্ধ পাহাড়ি রাস্তায় নিকশ কালো অন্ধকারে ডিগডিগ শব্দে আমার বুলেট ছুটছে, আর সাইলেন্সারের ওই বিকট আওয়াজ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
সুখিয়াপোখরির পর থেকেই দুটো অল্পবয়সী পাহাড়ি ছেলে বাইক নিয়ে আমাদের ফলো করছে মনে হল।  ছেলে দুটোকে ওই জটলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম।  কখনও আমাদের সামনে চলে যাচ্ছে, কখনও দেখছি পিছনে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পাহাড়ের ফাঁকা রাস্তায় মস্তিষ্কে একটা সংশয় কাজ করতে শুরু করল।  ওদের গতিবিধি সন্দেহজনক ঠেকছে।  সিমানা ভিউপয়েন্ট ক্রস করে গেলাম।  কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর মেইন রাস্তা থেকে একটা রাস্তা বাঁদিকে নেমে গিয়েছে সেখানে একটা সাদা মারুতি ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ড্রাইভারকে রঙভংয়ের রাস্তা জিজ্ঞেস করতেই বলল, এই রাস্তাটাই রঙভং চলে গিয়েছে।  বাইকের আলোয় রাস্তাটা দেখেই একটা আতঙ্ক চেপে বসল মনে।  পাঙ্খাবাড়ী, টাইগারহিল বা রক গার্ডেনে যাওয়ার মতো রাস্তা, একদম ঢালু, তার উপর রাস্তা পুরোপুরি ভাঙা।  একবার বাইক স্কিট করলে আর দেখতে হবে না, পরদিন স্মরণসভা নিশ্চিত।  হটাৎ সেই ছেলেদুটো ব্রেক কষে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,  “আপনারা রঙভং যাবেন ?  আমাদের বাড়িও রঙভং, আমরা রঙভং যাচ্ছি, আমাদের পিছন পিছন চলে আসুন। ওই ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ধরে খুব সাবধানে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি কিন্তু কনফিডেন্স পাচ্ছি না।  ওরা বুঝতে পেরে পিছনের সিটে বসা সুব্রতকে ওদের বাইকে নিয়ে নিলো আর আমাকে বলল, আস্তে আস্তে সাবধানে চলে আসুন।
রঙভংয়ে পৌঁছে একটা অসাধারণ হোমস্টেতে নিয়ে গিয়ে মালিককে ঘুম থেকে তুলে সেই রাতে আমাদের থাকার ও খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিয়ে নিশুতি রাতের অন্ধকারে ঝড়ের বেগে পাহাড়ের বুকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল ওরা।
লজ্জায় মাথা নীচু করে ছেলেদুটোর কথা ভাবছিলাম।  কত উঁচু দরের মানসিকতা হলে ঐরকম উপকার করা যায় !  ওরা বুঝেছিল – আমরা চিনি না, আমাদের কোন প্রি-বুকিং নেই এবং নিশুতি রাতের রঙভংয়ের ওই ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় আমাদের বিপদ হতে পারে, সেই কারণেই ফেরাশতা বা দেবদূতের মতো সেই সুখিয়াপোখড়ি থেকে আমাদের আগলে আগলে নিয়ে এসে নিশ্চিন্ত জীবনে পৌঁছে দিল। পাহাড় আমাকে অনেক অনেক দিয়েছে, ঝুলি পূর্ণ করে দিয়েছে।  অধিকাংশ জায়গার হোমস্টেগুলো থাকা খাওয়ার পয়সা নিতে চায় না, জোর করে গুঁজে দিতে হয়, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হতে হয়।  মিষ্টি মিষ্টি সম্পর্ক দিয়েছে আমাকে।  বিশ্বাস করেছে নির্দিধায়। পাহাড়ি এই মানুষগুলো অফুরান ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে, আর এই ছেলেদুটো যা দিলো, স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে বহুকাল…..সত্যিই ওদের ভোলা যাবে না। ভাবতে অবাক লাগে, এই স্বার্থ এবং সংকীর্ণতায় ভরা দুনিয়াতে পৃথিবীটা আজও কত সুন্দর, কত মায়াময় !!

Cumillar Voice’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।